প্রকাশ: ২০২০-০২-২৩ ০৭:৩১:০৯ || আপডেট: ২০২০-০২-২৩ ০৭:৩১:০৯
সুজন মজুমদার::
দীর্ঘ সংগ্রাম আর বহু ত্যাগের বিনিময় দুহাতে স্বপ্ন বুননে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে পাহাড়সম দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বছরের সূচনালগ্নে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত উদ্যাপিত হবে সর্ব প্রথম মুজিববর্ষ। প্রকৃতপক্ষে এই দুটি সাল জাতির জন্য অতীব তাৎপর্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের পরের বছরই ২০২১ সালে পালিত হবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব। আর এটা ভিশন ২০২১ সমাপ্তিরও বছর। এই দুই কর্মসূচি হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনে পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। ‘মুজিব বর্ষ’ পালনের মাধ্যমে দিন বদলের অগ্রযাত্রা বাস্তবায়ন হবে।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া শেখ মুজিবুর রহমান স্কুল জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে তার রাজনীতির দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন শেখ মুজিব। ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্য লাভ করেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শেখ মুজিবকে বারবার কারাগারে যেতে হয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাকে নিয়ে যায় বাঙালির অনন্য এক নেতৃত্বে। ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ ১৯৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। ’৭১-এর মার্চে শুরু করেন অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তার অগ্নিঝরা ঐতিহাসিক ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙালিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে অকুতোভয় বাঙ্গালীরা যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে । ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করার পর সে রাতেই বন্দি হন বঙ্গবন্ধু। তবে তার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। অন্যদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিদ্রোহের অভিযোগ এনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গোপন বিচারের নামে প্রহসন শুরু করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অবসান ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের এবং তা বাঙালিরই হাতে।
আমাদের এই ভূখণ্ডের জনগণ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার যে অদম্য ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন যুগ যুগ ধরে, তারই প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও ইতিহাসের মহানায়ক তিনি। সৎ, নিষ্ঠা, আদর্শ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন একজন বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের। তার সাধনা ছিল উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলার। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রভাবনা ও দর্শন, ন্যায় ও সত্যের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য, দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসায় জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কোনোদিন ম্লান হওয়ার নয়। তার প্রতি জাতির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অকৃত্রিম। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে, সামষ্টিক স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থের তাড়নায় বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ থেকে অধিকাংশ নেতা যোজন যোজন আজ দূরে সরে গেছেন। কারো কারো কাছে তো বঙ্গবন্ধু নিছকই একটি ছবি মাত্র। নীতিবিচ্যুতি, আদর্শহীন ও শ্রদ্ধাহীনভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়েই কেউ কেউ আজ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করছে না।
অনুপ্রবেশ, পল্টিবাজ ও স্বার্থবাদীরা দিনদিন দলে অন্তর্ভুক্তকরণে আওয়ামী লীগের আজ যৌবন ও গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ সঠিকভাবে পালন না করে তাকে প্রতিনিয়ত নানাভাবে বিক্রি করে এক শ্রেণির কুলাঙ্গার নেতারা রাজনীতি করছে। যা দল ও দেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। আমাদের স্বপ্নে গড়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ ও আদর্শ, ন্যায়-পরায়ণ, পরোপকারী, অসম্প্রদায়িক দেশ গড়ার অঙ্গীকার, শোষণমুক্ত, ক্ষুধা ও দারিদ্র, বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাহসী ও ত্যাগী নিষ্ঠাবান নেতাদের হাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি দেখতে চাই। দুর্নীতিমুক্ত একটি স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার রাজনীতি আশা করি নেতাদের কাছে।
আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি স্বাধীনদেশে বসবাস করি এসবই বঙ্গবন্ধুর অবদান। শুধু তাই নয়, এক কথায় বলতে হয় বাংলাদেশ মানে একটি বঙ্গবন্ধুর নাম। আজ স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন হবে। অত্যন্ত আনন্দের সাথে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই জন্মশতবর্ষ পালনের মাধ্যমে জাতি কিছুটা তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ পাবে এবং এটা আমাদের তার প্রতি দায়বদ্ধতা বলে আমি মনে করি।
সামগ্রিকভাবে মানুষের ইতিহাস হলো এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাসও এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে বাংলাদেশ আজ অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে এবং দারিদ্র্যও কমেছে। খাদ্য উৎপাদনে ও এখন আমরা স্বাবলম্বী। দিনদিন শিক্ষার হার বাড়ছে। গ্রামগঞ্জের মানুষেরাও আজ সচেতন। মূল কথা, আমরা যা পেয়েছি তার হিসাব থেকে আমরা প্রেরণা নেব। যা পাইনি পরিকল্পিত অর্জনের চেষ্টায় সেটা আমাদের অব্যাহত থাকতে হবে। সর্বোপরি আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে আবার আমরা দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠি, দিনবদলের সংগ্রামে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হই। শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য ও দুঃশাসনের চির অবসান ঘটাই। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু সমাজ গড়ে তুলি। একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগ্রামে নবজাগরণ সৃষ্টি করি। ‘মুজিব বর্ষ’ সামনে রেখে যদি এই ধরনের নবজাগরণ সৃষ্টি করা যায়, তবেই বর্ষটি পালন জাতির জীবনে সফল ও সার্থক হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।-নিউজ বাংলাদেশ
লেখক: সাংবাদিক